মানুষ আদিকাল থেকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়েছে। অসংখ্য তারার মাঝে জ্বলজ্বল করা নক্ষত্রমণ্ডল, ধূসর কুয়াশার মতো ছায়াপথ, আর রাতের আকাশে রহস্যে মোড়ানো অন্ধকার – সবকিছুই এক অদ্ভুত কৌতূহল জাগায়। এই কৌতূহল থেকেই শুরু হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের যাত্রা। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা আজ জানি, এই আকাশে শুধুই নক্ষত্র নয়, নক্ষত্রের বিশাল বিশাল সমষ্টি আছে যেগুলোকেই আমরা বলি “গ্যালাক্সি” বা ছায়াপথ।
এই প্রবন্ধে আমরা জানব—মহাবিশ্বে মোট কতটি গ্যালাক্সি রয়েছে, কীভাবে বিজ্ঞানীরা এই সংখ্যা অনুমান করেন, গ্যালাক্সির ধরন ও গঠন কেমন, তাদের মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে, এবং ভবিষ্যতের গবেষণায় আমরা আর কী কী জানতে পারি।
গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ হলো মহাকাশে অবস্থিত এক একটি বিশাল নক্ষত্রগুচ্ছ, যা ধূলিকণা, গ্যাস, অন্ধকার পদার্থ এবং নানা ধরণের মহাজাগতিক বস্তু দ্বারা গঠিত। প্রতিটি গ্যালাক্সিতে শত কোটি থেকে শুরু করে হাজার হাজার কোটি পর্যন্ত নক্ষত্র থাকতে পারে।
আমাদের সৌরজগত যে গ্যালাক্সির অংশ, সেটির নাম মিল্কি ওয়ে (Milky Way)। এটি একটি স্পাইরাল টাইপের গ্যালাক্সি, যেখানে সূর্য একেবারে কেন্দ্রে নয়, বরং মাঝামাঝি এক বাহুর ধারে অবস্থান করছে।
১৯৯৫ সালে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের খুব ছোট একটি অংশ পর্যবেক্ষণ করেন যেটিকে বলা হয় “Hubble Deep Field”। মাত্র কয়েক বর্গ মিনিট আকাশের একটি অংশে ৩০০০ এর বেশি গ্যালাক্সি চিহ্নিত করা হয়।
এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা পুরো মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির সংখ্যা অনুমান করেন। তাদের হিসাব অনুযায়ী, দৃশ্যমান মহাবিশ্বে আনুমানিক ১০০ বিলিয়ন (১০,০০,০০০ কোটি) গ্যালাক্সি থাকতে পারে।
২০১৬ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার কনসেলিসের নেতৃত্বে একটি গবেষণায় দেখা যায়, আসলে দৃশ্যমান মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির সংখ্যা ২ ট্রিলিয়নের বেশি হতে পারে। অর্থাৎ ২,০০,০০,০০,০০,০০০টি গ্যালাক্সি!
তবে এই সংখ্যা এখনও চূড়ান্ত নয়, কারণ বহু গ্যালাক্সি এখনও টেলিস্কোপে ধরা পড়েনি।
গ্যালাক্সির আকার, গঠন ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিজ্ঞানীরা সাধারণত গ্যালাক্সিকে চারটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করেন:
এই ধরনের গ্যালাক্সিতে একটি কেন্দ্রীয় বালজ থাকে, যেখান থেকে বাহুর মতো গঠিত নক্ষত্রপুঞ্জ বের হয়ে আসে।
মিল্কি ওয়ে এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
এসব গ্যালাক্সি সাধারণত উজ্জ্বল এবং নতুন নক্ষত্রের জন্ম এখানেই বেশি ঘটে।
ডিম্বাকার বা গোলাকার গঠনবিশিষ্ট।
নক্ষত্রের ঘনত্ব অনেক বেশি এবং এখানে নতুন নক্ষত্রের জন্ম কম ঘটে।
সাধারণত বৃদ্ধ গ্যালাক্সি বলা হয়।
নির্দিষ্ট কোন গঠন বা আকৃতি নেই।
একাধিক গ্যালাক্সির সংঘর্ষ বা মিথস্ক্রিয়ার ফলে এদের গঠন এলোমেলো হয়ে যায়।
স্পাইরাল ও এলিপটিক্যাল গ্যালাক্সির মাঝামাঝি ধরনের।
গঠন একটি ডিস্কের মতো হলেও স্পাইরাল বাহু থাকে না।
গ্যালাক্সি দেখতে হলে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ ব্যবহার করতে হয়। পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে গ্যালাক্সি দেখা বেশ কঠিন, কারণ বায়ুমণ্ডল অনেক আলো শোষণ করে ফেলে। এজন্য স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহৃত হয়, যেমন:
Hubble Space Telescope (1990)
James Webb Space Telescope (2021)
Spitzer Space Telescope
Chandra X-ray Observatory
এইসব টেলিস্কোপ দিয়ে মহাবিশ্বের বহুদূর পর্যন্ত গ্যালাক্সির ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে।
একটি নির্দিষ্ট আকাশের অংশে দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই অংশের গ্যালাক্সি গুনে, পরে পুরো মহাবিশ্বের জন্য extrapolate করা হয়।
প্রতিটি গ্যালাক্সিতে নিম্নলিখিত উপাদান থাকে:
নক্ষত্র – প্রধান গঠন উপাদান
গ্যাস ও ধূলিকণা – নতুন নক্ষত্র তৈরিতে সহায়তা করে
ডার্ক ম্যাটার – একধরনের অদৃশ্য পদার্থ, যেটি গ্যালাক্সির ভর ও গঠনকে প্রভাবিত করে
নিউট্রন স্টার, ব্ল্যাক হোল ইত্যাদি
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বড় গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এডউইন হাবল প্রথম দেখান যে, গ্যালাক্সিগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের প্রসারণের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এর মানে হলো, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, এবং এর ফলে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যকার দূরত্ব বাড়ছে। এই প্রসারণ চলমান থাকলে ভবিষ্যতে আরও অনেক গ্যালাক্সি হয়তো আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে।
আন্দ্রোমিডা গ্যালাক্সি – আমাদের সবচেয়ে কাছের বড় গ্যালাক্সি। এটি মিল্কি ওয়ের দিকে ধেয়ে আসছে। প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর পরে এই দুটি গ্যালাক্সির সংঘর্ষ হতে পারে।
আইকেনস স্টিয়ারিং হুইল গ্যালাক্সি – এটি দেখতে হুইল বা চাকতির মতো, যা গ্যালাক্সির মধ্যে সংঘর্ষের কারণে এমন আকৃতি পেয়েছে।
সাবারু এক্সট্রিম ডিপ ফিল্ড – এখানে প্রায় ১ লক্ষ গ্যালাক্সি একই ছবিতে ধরা পড়েছে।
নতুন প্রজন্মের টেলিস্কোপ যেমন জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আরও দূরবর্তী ও প্রাচীন গ্যালাক্সির ছবি তুলতে সক্ষম হচ্ছে। এতে করে:
গ্যালাক্সির উৎপত্তি সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে
প্রথম গ্যালাক্সির বিবর্তন বোঝা যাচ্ছে
ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির ভূমিকা বিশ্লেষণ করা সম্ভব হচ্ছে
মহাবিশ্ব এক বিশাল রহস্য। গ্যালাক্সিগুলোর সংখ্যা, গঠন, সংঘর্ষ ও বিবর্তন নিয়ে আমরা যতই জানছি, ততই নতুন প্রশ্ন উঠে আসছে। বর্তমানে অনুমান করা হয় দৃশ্যমান মহাবিশ্বে ২ ট্রিলিয়নের মতো গ্যালাক্সি রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে এই সংখ্যা হয়তো আরও নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।
বিজ্ঞান যত এগোবে, ততই আমরা জানতে পারব—এই অসীম মহাবিশ্বে আমরা কতটা ক্ষুদ্র, আবার কতটা সৌভাগ্যবান যে এত অসাধারণ জ্ঞান আহরণের সুযোগ পাচ্ছি।
NASA – Hubble Space Telescope Archives
গ্যালাক্সির সংখ্যা, Hubble Deep Field ও Hubble Ultra Deep Field এর পর্যবেক্ষণের তথ্য।
ESA – European Space Agency
মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির পরিমাণ ও গঠন সংক্রান্ত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গবেষণা।
NASA Goddard Space Flight Center
Christopher Conselice এবং তার দলের গবেষণা, যা ২০১৬ সালে ২ ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সির ধারণা দেয়।
সংক্ষেপ: “The Evolution of Galaxy Number Density at High Redshift”
James Webb Space Telescope (JWST) Mission Data
প্রাচীন গ্যালাক্সি এবং মহাবিশ্বের শুরুতে গঠিত গ্যালাক্সির তথ্য।
Scientific Journals & Publications:
Astrophysical Journal, Nature Astronomy, Monthly Notices of the Royal Astronomical Society (MNRAS)
এগুলোতে গ্যালাক্সি গণনার প্রযুক্তি, বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ গবেষণা সম্পর্কে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
Wikipedia (for general structure and cross-verification)
মন্তব্য করুন